ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক করতে তার আরব মিত্রদের সামনে ঠেলে দিলেও সৌদি আরব নিজে যে পিছিয়ে যাচ্ছে সেই ইঙ্গিত দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। গত দুদিনে সৌদি রাজপরিবারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুই সদস্যের মুখে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যা শোনা গেছে তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ইসরায়েলি নেতারা। সৌদি আরব পিছিয়ে গেলে বাকি আরব দেশগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি দাঁড়াবে তা নিয়েও তাদের মনে উদ্বেগ ঢুকছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, গত মাসে সৌদি আরবের নিওম শহরে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সৌদি যুবরাজ মোহামেদ বিন সালমানের মধ্যে গোপন এক বৈঠকের পর পর্যবেক্ষকরা বলতে শুরু করেন যে সৌদি আরব-ইসরায়েল কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। যদিও সৌদি আরব ওই বৈঠক হওয়ার কথা অস্বীকার করেছে। কিন্তু ইসরায়েল সরকারের মৌনতা এবং পশ্চিমা গোয়েন্দাদের ইঙ্গিতের ভিত্তিতে প্রায় সবাই নিশ্চিত যে বৈঠকটি হয়েছিল।
কিন্তু বাহরাইনের রাজধানী মানামায় মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা নিয়ে এক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে শনিবার সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সল বিন ফারহান বার্তা সংস্থা এফপির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যেসব কথা বলেন, তাতে সৌদি মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
প্রিন্স ফয়সল বলেন, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র না হলে ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের স্বাভাবিক সম্পর্ক হবে না। এ ব্যাপারে সৌদির অবস্থান শক্ত।
তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব এ নিয়ে খুব স্পষ্ট যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলে ফিলিস্তিন বিরোধ সমাধান করতে হবে, ২০০২ সালে আরব শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বাধীন টেকসই একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হতে হবে।’
‘ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের বিরোধ না মিটলে এই অঞ্চলে সত্যিকারের শান্তি ও স্থিতিশীলতা আসবে না’, যোগ করেন সৌদি মন্ত্রী।
২০০২ সালে সৌদি উদ্যোগে ওই শান্তি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূমি ইসরায়েলকে ছেড়ে দিতে হবে এবং পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। ইসরায়েল সবসময় এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের যুক্তি এতে তাদের নিরাপত্তা দারুণভাবে বিঘ্নিত হবে।
সৌদি এই অবস্থানের ফলে তো ইসরায়েলের সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে স্বাভাবিক সম্পর্কের সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যাবে? এই প্রশ্নে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ফিলিস্তিন বিরোধের সমাধানের ব্যাপারে আমি আশাবাদী।’
বাহরাইনে ওই সম্মেলনে আরও আক্রমণাত্মক কথা বলেছেন সৌদি সাবেক গোয়েন্দা প্রধান এবং রাজপরিবারে প্রভাবশালী সদস্য প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সল, যিনি সৌদি প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন। সরাসরি ইসরায়েলের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল সবসময় নিজেদেরকে দেখায় যে তারা ছোট একটি দেশ আর চারদিকে শত্রু সব দেশ সবসময় তাদের ধ্বংস চায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ইসরায়েল নিজে একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ।’
প্রিন্স তুর্কি (যিনি সৌদি বাদশাহ সালমানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত) বলেন, ‘এখনো ইসরায়েল জবরদস্তি করে ফিলিস্তিনিদের ঘরছাড়া করছে, তাদের গ্রাম ধ্বংস করছে। আব্রাহাম চুক্তি (ইসরায়েলের সঙ্গে ইউএই এবং বাহরাইনের চুক্তি) ঐশ্বরিক কোন দলিল নয়। শরীরের ঘা থাকলে তা ব্যথার ওষুধ দিয়ে সারানো যায় না।’
সৌদিরা তাদের উপসাগরীয় মিত্রদের ঠেলে দিয়ে নিজেরাই এখন পিছিয়ে যাচ্ছে কেন?
লন্ডনে ভূ-রাজনৈতিক নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান ড সাদি হামদি বিবিসি বাংলাকে বলেন, সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সলের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে বাদশাহ সালমান এবং তার ছেলে যুবরাজ মোহাম্মদের মধ্যে কতটা মতভেদ রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘প্রিন্স তুর্কি বাদশাহ সালমানের খুবই ঘনিষ্ঠ। তিনি মানামায় ইসরায়েলকে আক্রমণ করে যা বলেছেন তা সৌদি বাদশাহের মনোভাবের প্রতিফলন। ফিলিস্তিনিদের কিছু না পাইয়ে দিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সৌদি বাদশাহর তীব্র আপত্তি রয়েছে।’
প্রিন্স তুর্কি বলেন, ‘সৌদি নেতৃত্বের বড় একটি অংশ এখনো সাধারণ আরব জনগণের মতামত নিয়ে চিন্তিত। তারা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তিত। তলে তলে ইসরায়েলের সঙ্গে বেশ অনেকদিন ধরে নানা সম্পর্ক থাকলেও সৌদি নেতৃত্বের এই অংশটি এখনো দেখাতে চায় যে মক্কা ও মদিনার মসজিদের রক্ষক হিসেবে ফিলিস্তিন সমস্যার মতো মুসলিম বিশ্বের মূল কিছু বিষয়কে সৌদি আরব গুরুত্ব দেয়। সুতরাং এটা প্রজন্মের বিভেদ, বাবা ও ছেলের মধ্যে বিভেদ।’
ইসরায়েল কতটা উদ্বিগ্ন?
সৌদি প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সল যখন বাহরাইনের মানামায় রোববার ইসরায়েলের কঠোর সমালোচনা করছিলেন তখন জেরুজালেম থেকে ভিডিও কলের অন্য প্রান্তে বসে তা শুনছিলেন ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্যাবি আশকেনাজি। তার বক্তব্যের শুরুতেই ইসরায়েলি মন্ত্রী সৌদি প্রিন্সের বক্তব্যের প্রসঙ্গ তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিবর্তন শুরু হয়েছে, আমি মনে করি না সৌদি প্রতিনিধির এই ধরনের বক্তব্য তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।’
ইসরায়েলি মন্ত্রী বলেন, আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের অর্থ এই নয় যে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ চাপা দেওয়া হচ্ছে। বরঞ্চ আব্রাহাম চুক্তি এই সঙ্কট সমাধানের সুযোগ করে দিয়েছে।
ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তারা যেন কোনো শর্ত ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে মীমাংসা আলোচনায় এগিয়ে আসেন, যদিও এ ধরনের আহ্বানের কোনো গুরুত্বই নেই।
দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসা আলোচনা ২০১৪ সালের পর থেকে বন্ধ হয়ে রয়েছে। সম্মেলনে ভাষণ শেষ করে আশকেনাজি টুইট করেন, ‘মানামার সম্মেলনে সৌদি প্রতিনিধির অভিযোগ ভিত্তিহীন। তার বক্তব্য আমি প্রত্যাখ্যান করছি। এই ধরনের দোষারোপের দিন শেষ হয়েছে। আমরা নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছি। এই যুগ শান্তির যুগ।’
ইসরায়েলে নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা সংস্থা জেরুজালেম ইন্সটিটিউট অব স্ট্রাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটি‘র (জেআইএসএস) গবেষক ড. জনাথন স্পায়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, সম্পর্ক নিয়ে সৌদিদের এই দ্বিধা অবশ্যই ইসরায়েলের কাছে কিছুটা উদ্বেগের। কারণ সৌদি আরব খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। অন্য কিছু দেশ তাদের সিদ্ধান্তের জন্য রিয়াদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যেমন-মরক্কো।
ড. স্পায়ার বলেন, ইসরায়েল বুঝতে পারছে, সৌদি নেতৃত্বের মধ্যে একটি প্রজন্মগত বিরোধ চলছে এবং আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক হতে সময় লাগবে। কিন্তু তিনি মনে করেন, বেশ কয়েকবছর ধরে দুই দেশের মধ্যে গোপনে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে সহযোগিতা চলছে তা অব্যাহত থাকবে।
তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েল সৌদি আরবের জন্য এখন একটি প্রয়োজন। যুবরাজ মোহাম্মদ তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে বদ্ধপরিকর। ইসরায়েলের প্রযুক্তি তার দরকার। ইরানের হুমকি রয়েছে। তা ছাড়া সৌদি নেতারা খুব ভালো জানেন যে, মানবাধিকার বা বিভিন্ন ইস্যুতে যে ভাবমূর্তির সঙ্কট পশ্চিমা বিশ্বে তাদের রয়েছে ওয়াশিংটনে দেন-দরবার করে তার কিছুটা সুরাহা করে দেওয়ার ক্ষমতা ইসরায়েলের রয়েছে।’
ড সাদি হামদিও মনে করেন, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের শর্ত হিসেবে ফিলিস্তিনিদের প্রসঙ্গ নিয়ে আসার অর্থ এই নয় যে সৌদি আরবের অবস্থানে মৌলিক কোনো পরিবর্তন হচ্ছে। মিশর ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর তৎকালীন সৌদি বাদশাহ যে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছিলেন ইউএই’র বেলায় তো তা দেখছি না। সৌদি বাদশাহ কি ইউএই’র নিন্দা করেছেন? সৌদি সবুজ সংকেত ছাড়া বাহরাইন এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই নিতে পারতো না। ইসরায়েলের বিমানের জন্য সৌদি আকাশ খুলে দেওয়া হয়েছে।’
‘সৌদি নেতাদের কাছ থেকে যা শুনছি তার কিছুটা অভ্যন্তরীণ মতভেদের বহিঃপ্রকাশ এবং কিছুটা জনসংযোগের চেষ্টা’, যোগ করেন ড সাদি হামদিও।
তাহলে সৌদিদের বক্তব্য-বিবৃতিতে ফিলিস্তিনিদের খুশি হওয়ার তেমন কি কোনো কারণ নেই? এ ব্যাপারে ড. সাদি হামদি মনে করেন, ‘কিছুটা স্বস্তির কারণ হলেও ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের সুরাহার কোনো সম্ভাবনা নেই। ফিলিস্তিনিরা হয়তো কিছুটা স্বস্তি পাবে যে তাদের ইস্যুটি একদম মাটির নিচে চলে যায়নি। একটা চাপ তো অবশ্যই ইসরায়েলের ওপর তৈরি হবে। কিন্তু তা খুব সামান্যই।’
ড. জনাথন স্পায়ারও মনে করেন, ‘সৌদি বাদশাহ চাইছেন বলেই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে ইসরায়েল উদ্যোগ নেবে সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সমস্যা খুবই জটিল। একটি বৈঠক বা কারও দাবিতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন সেখানে হবে না। ফিলিস্তিনিরা নিজেরাও বিভক্ত। গাজায় হামাস আর পশ্চিম তীরে ফাতাহর মধ্যে কোনো যোগাযোগ কথাবার্তা নেই। এই অচলাবস্থা অদূর ভবিষ্যতে কাটবে না।’
ড. হামদি বলেন, ‘ইসরায়েলিরা জুয়া খেলবে। অপেক্ষা করবে বাদশাহ সালমানের মৃত্যুর জন্য। তারা এটাও জানে জো বাইডেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বদল চাইবেন না।’
Leave a Reply